নদীর মাঝখানে ছোট্ট ছানিযুক্ত নৌকায় বসে তাদের এই নির্জন সময় যেন সময়কে থামিয়ে দিয়েছিল। দূরের পাখির ডাক, হালকা বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর পানির মৃদু শব্দ মিলেমিশে তৈরি করেছিল এক অলৌকিক সুর।
মায়া হঠাৎ বলল, “রুদ্র, জানো, এই জায়গাটা আমার স্বপ্নের মতো মনে হয়। মনে হয়, এই নদী, এই নৌকা, আর তুমি—সবটাই যেন কোনো গল্পের অংশ।”
রুদ্র মৃদু হেসে বলল, “তুমি তো আমার গল্পের সবচেয়ে সুন্দর অংশ, মায়া। তোমার সঙ্গে থাকলে মনে হয়, জীবনের সব কিছুর অর্থ খুঁজে পেয়েছি।”
হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে গেল মায়ার ঠোঁটে। কিন্তু সেই হাসি টিকল না বেশিক্ষণ। হঠাৎই তাদের মনোযোগ কেড়ে নিল আকাশের রং।
নদীর ওপরে কালো মেঘের স্তূপ জমে উঠছিল। পাখিরা যেন ভয় পেয়ে উড়ে পালাচ্ছিল। বাতাসের গতিও বদলে গেল মুহূর্তেই। নদীর ঢেউগুলোও একটু একটু করে উত্তাল হতে শুরু করল।
রুদ্র চিন্তিত হয়ে বলল, “মায়া, ঝড় আসছে মনে হয়। আমাদের তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত।”
মায়া একটু ভীত স্বরে বলল, “তুমি কি চালাতে পারবে? ঢেউ তো বেশ বড় হচ্ছে।”
“চিন্তা করো না,” রুদ্র আশ্বস্ত করল। “তুমি শুধু নৌকার মাঝখানে বসে থাকো। আমি সামলে নেব।”
কিন্তু ঝড়ের প্রকোপ এত সহজে সামলানোর মতো ছিল না। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। প্রথমে ছোট ফোঁটা ফোঁটা, তারপর যেন আকাশের সমস্ত পানি একসঙ্গে ঝরে পড়তে শুরু করল।
রুদ্র নৌকাটি চালানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু ঢেউ আর বাতাস এতটাই শক্তিশালী ছিল যে নৌকাটি তীরের দিকে না গিয়ে মাঝনদীর দিকে ভেসে যাচ্ছিল।
মায়া ভয়ে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরল। “রুদ্র, কিছু একটা কর! আমি ভয় পাচ্ছি।”
“মায়া, ভয় পেও না। আমি আছি তোমার সঙ্গে,” রুদ্র বলল। কিন্তু তার নিজের কণ্ঠেও ছিল উদ্বেগের ছোঁয়া।
হঠাৎ একটি বড় ঢেউ এসে তাদের নৌকাটি একপাশে উল্টে দিল। রুদ্র আর মায়া পানিতে পড়ে গেল। তাদের চারপাশে শুধু পানি আর উত্তাল ঢেউ। মায়া চিৎকার করে রুদ্রকে ডাকল, “রুদ্র! তুমি কোথায়?”
রুদ্র কোনো মতে মায়ার হাত ধরে বলল, “আমি এখানে আছি। ভয় পেও না।
আমরা একসঙ্গে আছি, এটা আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে।”তারা দুজন হাতে হাত রেখে নদীর স্রোতের সঙ্গে ভেসে চলছিল। বৃষ্টি তখনো থামেনি, কিন্তু তাদের ভেতরে অদ্ভুত এক শান্তি কাজ করছিল। মায়া অনুভব করল, যত ভয়ংকরই পরিস্থিতি হোক, রুদ্রের উপস্থিতি তাকে শক্তি দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর নদীর স্রোত তাদের একটি তীরের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। রুদ্র কোনো মতে মায়াকে ধরে তীরে উঠতে সাহায্য করল। তারা দুজনই ভেজা, ক্লান্ত আর শীতার্ত। কিন্তু যখন তারা তীরের কাদামাখা মাটিতে বসে পরস্পরের দিকে তাকাল, তখন সেই ক্লান্তি কোথাও মিলিয়ে গেল।
রুদ্র মায়াকে জড়িয়ে ধরে বলল, “দেখলে, আমি বলেছিলাম আমরা ঠিক একসঙ্গে থাকব।
ঝড় আসুক, বৃষ্টি আসুক, কোনো কিছুই আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”
মায়ার চোখ থেকে তখন জল ঝরছিল, কিন্তু সে জানত না সেটা বৃষ্টির পানি নাকি তার নিজের অশ্রু। সে কেবল মাথা নাড়িয়ে বলল, “তোমার সঙ্গে থাকলে মনে হয়, আমি পৃথিবীর সব ঝড় সামলাতে পারব।”
আকাশে তখনো মেঘ, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই মেঘের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো দেখা দিতে শুরু করল। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে মিশে গাছের পাতাগুলো ঝরে পড়া পানির শব্দ এক নতুন সুর তৈরি করেছিল। এই সুর যেন তাদের প্রেমের সাক্ষী হয়ে রইল।
রুদ্র আর মায়া তীরে বসে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে থাকল, ঠিক যেন ঝড়ো রাতের সেই অন্ধকারেও তারা একে অপরের আলো।
-------------- সমাপ্ত -----------
No comments:
Post a Comment