ঢাকা থেকে সিলেটগামী একটি ট্রেনের কেবিন। রাতের সময়। হালকা শীতের আমেজ। কেবিনের আরামদায়ক পরিবেশে জানালার পাশে বসে আছি আমি। পাশের সিটে একজন মধ্যবয়সী মহিলা, হয়তো ৩৫-৩৬ হবে। তার পোশাক-আশাক সাধারণ হলেও একটি ধরনের আভিজাত্য রয়েছে তার মুখে। চোখে স্পষ্ট এক অদ্ভুত রহস্য।
সন্ধ্যা নামার পর থেকেই তিনি কিছুটা চুপচাপ ছিলেন। মাঝে মাঝে বাইরে তাকাচ্ছিলেন, কখনো মোবাইলে কিছু দেখছিলেন। ট্রেনের ছন্দময় শব্দে আমি ভাবনায় ডুবে ছিলাম—জীবনের নানা জটিলতা আর ব্যস্ততা থেকে একটু মুক্তি নেওয়ার জন্যই এই ভ্রমণ। হঠাৎ পাশের মহিলা আমাকে প্রশ্ন করলেন,
“আপনি কি সিলেটে যাচ্ছেন বেড়াতে?”
আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, “হ্যাঁ। জাফলং যাওয়ার পরিকল্পনা। আপনি?”
তিনি মুচকি হাসলেন।
উত্তর দিলেন, “আমার কাজ আছে সিলেটে। তবে আপনার পরিকল্পনা শুনে বেশ ভালো লাগছে।”
এরপর কথায় কথায় জানা গেল, তার নাম রুবি। ঢাকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ব্যক্তিগত কাজে সিলেটে যাচ্ছেন বলে জানালেন। তবে তার কথাবার্তায় একধরনের অস্পষ্টতা ছিল, যা আমার কৌতূহল বাড়িয়ে দিচ্ছিল।
সিলেট স্টেশনে পৌঁছানোর পর সবাই ট্রেন থেকে নামতে শুরু করল। রুবি নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হঠাৎ তার ব্যাগের চেন খুলে একটি ডায়েরি নিচে পড়ে গেল। তিনি সেটি তাড়াহুড়া করে তুলে নিলেন, কিন্তু ততক্ষণে ডায়েরির পাতা থেকে একটা কাগজ বেরিয়ে আমার পায়ের কাছে এসে পড়ল। কাগজটি তুলে দিয়ে দেখি, তাতে একটি ঠিকানা লেখা এবং একটি কবিতার লাইন:
“জীবনের প্রতিটি বাঁকে যদি কারো হাতে হাত রাখতে পারি, তবে মৃত্যুও আমাকে হারাতে পারবে না।”
কাগজটি পড়ার পর তাকে ফেরত দিলাম।
তিনি কিছুটা লজ্জিত হয়ে হাসলেন। কাগজটি নেয়ার সময় বললেন, “অনেক পুরনো কবিতা। স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখেছি।”
স্টেশন থেকে বের হওয়ার পর আমার হোটেলে উঠলাম। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রুমে ঢুকেই ভাবতে শুরু করলাম সেই মহিলার কথা। কেন জানি না, তার কথাগুলো, মুখের হাসি, এমনকি তার সেই রহস্যময় চোখ—সবকিছুই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল।
পরদিন সকালে আমি জাফলং যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হোটেল থেকে বের হতে গিয়ে আবার সেই রুবির সঙ্গে দেখা। আশ্চর্যের বিষয়, তিনিও জাফলং যাচ্ছেন। আবারও একসঙ্গে যাত্রা শুরু করলাম। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেখতে তিনি হঠাৎ করে বললেন,
“জাফলং-এর সৌন্দর্য এত মায়াময় যে, এখানে এলে মন হারিয়ে যায়। তবে আপনি জানেন কি, প্রকৃতি শুধু বাহ্যিক নয়, মনের সৌন্দর্যও খোঁজে?”
আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, “আপনি এত গভীর কথা বলছেন কেন?”
তিনি হেসে বললেন, “কখনো কখনো মানুষ নিজের কষ্ট আড়াল করার জন্য প্রকৃতির সাহায্য নেয়।
আপনি জানেন কি, কেউ যদি প্রকৃতির সঙ্গে নিজের মনের মিল খুঁজে পায়, তাহলে জীবনের ভার অনেকটাই হালকা হয়।”
আমি বুঝতে পারছিলাম, রুবির কথার মধ্যে কোনো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ছাপ লুকিয়ে আছে। কিন্তু তার বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস করিনি।
জাফলং পৌঁছানোর পর আমরা পাথরের নদী, ঝর্ণা, চা বাগান ঘুরতে শুরু করলাম। এরই মধ্যে একসময় তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আপনার কি মনে হয়, মানুষের জীবনে সবসময় সুখ-দুঃখের ভারসাম্য থাকা উচিত?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, তবে আমরা প্রায়ই সেই ভারসাম্য খুঁজে পাই না। আপনার কি মনে হয়?”
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমার জীবনটা এমন এক ভারসাম্যের খোঁজেই চলছে। কখনো পাই, কখনো হারাই।”
আমাদের আলাপ চলতেই থাকল। জাফলং-এর সৌন্দর্যের মাঝে তার জীবনকাহিনি যেন এক নতুন মাত্রা যোগ করছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, রুবির জীবনে কোনো গভীর দুঃখ বা অভিজ্ঞতা লুকিয়ে আছে, যা সে কারো সঙ্গে ভাগ করতে পারছে না।
শেষমেশ, যখন সূর্য ডোবার সময় হলো, তিনি একটি পাথরের উপর বসে বললেন, “আপনি কি জানেন, কিছু মানুষের জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যা তাদের পুরো জীবন বদলে দেয়?”
আমি চুপ করে শুনছিলাম।
তিনি বললেন, “আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন কয়েক বছর আগে। কিন্তু তার রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলো এখনো আমার জীবনের অংশ। আমি ভেবেছিলাম, তার চলে যাওয়া হয়তো আমার জীবনের সমাপ্তি। কিন্তু জাফলং-এর মতো জায়গাগুলো আমাকে শিখিয়েছে, জীবনের শেষ মানেই সবশেষ নয়।”
তার কথাগুলো শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এই ভ্রমণে আমি শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখিনি, একজন মানুষের জীবন থেকে শেখার সুযোগও পেয়েছি।
সেদিন সূর্যাস্তের মুগ্ধ আলোতে রুবির মুখটি যেন আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
তিনি চলে যাওয়ার সময় বললেন, “আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল। যদি কখনো সুযোগ হয়, আবার দেখা হবে।”
তারপর তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন ভিড়ের মাঝে। কিন্তু তার স্মৃতিগুলো আমার মনে স্থায়ী হয়ে রইল। >--------------- শেষ ------------<
No comments:
Post a Comment